দুদক চায় মানি লন্ডারিং আইনের পুরো ক্ষমতা

Passenger Voice    |    ১২:০২ পিএম, ২০২২-০১-০৪


 দুদক চায় মানি লন্ডারিং আইনের পুরো ক্ষমতা

মানি লন্ডারিং আইনে ২৭টি ধারা। এর মধ্যে মাত্র একটি ধারা রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে। বাকি ২৬টির ক্ষমতা দেওয়া আছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে। ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধনের আগ পর্যন্ত সব ধারার একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থ পাচার অপরাধ তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থায় সফলতা দেখিয়েছিল দুদক।

আইনটি সংশোধনের পর কমিশনের দেশে-বিদেশে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের পরিধি একেবারেই ছোট হয়ে আসে। এ রকম প্রেক্ষাপটে মানি লন্ডারিং আইন-২০১২ এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোর ক্ষমতা ফেরত চায় দুদক। এ জন্য শিগগির মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সরকারের কাছে লিখিত আবেদন জমা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে আবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। দুদকের এই আবেদন আইন সংক্রান্ত হওয়ায় এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পাঠানো হবে আইনমন্ত্রীর কাছে। পরে মন্ত্রী আইনটি সংশোধন করা-না করার বিষয় বিবেচনা করবেন। আইনটি সংশোধন করা হলে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খসড়া সংশোধনী আইন পেশ করতে হবে জাতীয় সংসদে।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, ক্ষমতা খর্ব করে দুদককে দমিয়ে রাখতে দীর্ঘদিন থেকেই একটি চক্র সক্রিয় ছিল। ২০১৫ সালে ও তার আগের সময়গুলোতে যখন অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দুদকের সাঁড়াশি অভিযান চলছিল, তখন ওই চক্রটি সরকারের ভেতরে-বাইরে অবস্থান করে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধনের বিষয়টি সামনে আনে। ওই সময় সরকারের কিছু সংস্থাও এ আইনের ক্ষমতা ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।

সূত্র জানায়, ওই সংশোধিত আইনে দুদককে দেওয়া হয়েছিল শুধু দুর্নীতি ও ঘুষের ধারাটি। অন্য ছয় সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল প্রতারণা, চাঁদাবাজি, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, চোরাচালানি ও শুল্ক্ক সংক্রান্ত অপরাধ, কর সংক্রান্ত অপরাধ, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ, মুদ্রা, দলিল দস্তাবেজ জালকরণসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধারার ক্ষমতা। আইন সংশোধন করে ক্ষমতা খর্ব করার পর থেকে এসব ক্ষেত্রে দুদকের কোনো অর্জন নেই বললেই চলে।

সিআইডি ছাড়া আরও যে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে মানি লন্ডারিং আইনের বিভিন্ন ধারার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

মানি লন্ডারিং আইনে ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় দেশে-বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে দুদক এখন অনেকটাই 'অক্ষম'। স্বয়ং আইনমন্ত্রী বলছেন, দুদক চাইলে মানি লন্ডারিং আইনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, আইন সংশোধনের নামে দুদককে দুর্বল করা হয়েছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আগে যখন দুদকের কাছে মানি লন্ডারিং আইনের সব ক্ষমতা ছিল তখন খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া প্রায় ২১ কোটি টাকা আইনি প্রক্রিয়ায় ২০১৩ সালে ফেরত এনেছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের বিরুদ্ধে করা মামলায় আরও ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রায় ৮০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড ফ্রিজ করা হয়েছে। সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলায় ছয় কোটি টাকা যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত আনার জন্য আদালতের আদেশ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস ও গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ অন্যান্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা পাচার হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানির (ট্রেড বেজ) আড়ালে। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনে এ ধরনের অর্থ পাচারের অভিযোগ দুদক তদন্ত করতে পারছে না।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে ফাঁস হওয়া আলোচিত পানামা, প্যারাডাইস, প্যান্ডোরা পেপারস, মালয়েশিয়ার 'মাই সেকেন্ড হোম প্রকল্প', কানাডার বেগমপাড়ায় বিনিয়োগ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্য ট্যাক্স হ্যাভেন নামে পরিচিত দেশে বাংলাদেশিদের অবৈধ বিনিয়োগ, দেশের অভ্যন্তরে ই-কমার্স সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করতে পারছে না দুদক। নন ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার অর্থেরও তদন্ত করা যাচ্ছে না।

সরকারি কর্মচারীর ঘুষ ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অপরাধ এবং সেখান থেকে উদ্ভূত মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করতে পারে দুদক। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার, হুন্ডি ও অন্যান্য অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(ঠ) ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ এর তপশিলে বর্ণিত অনুসন্ধান, তদন্তের জন্য নির্ধারিত সংস্থার তালিকার সংশোধন চাইছে দুদক। দুদক নিদেনপক্ষে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ক্রমিক ৩, ৫, ৬, ১৪, ১৮, ১৯ ও ২৫ ধারার ক্ষমতা পাওয়া সংস্থাগুলোর নামের পাশাপাশি নিজের নামটি যুক্ত চায়। যাতে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি দুদক ওইসব ধারার অপরাধ তদন্ত করতে পারে।

আইনের ৩, ৫, ৬, ১৪, ১৮, ১৯ ও ২৫ ধারায় যথাক্রমে দলিল দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা, জালিয়াতি, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, শুল্ক্ক সংক্রান্ত অপরাধ, কর সংক্রান্ত অপরাধ, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ উল্লেখ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। পরে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০০৮ জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশের অপরাধগুলো দুদকের তপশিলভুক্ত করা হয়। বলা হয়, দুদকের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও ওই অপরাধ তদন্ত করতে পারবে। ওই সময় ১৭টি অপরাধের সবই দুদক তদন্ত করত। পরে আবার অধ্যাদেশটি বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ পাস করা হয়। ওই সময় সব ধারা দুদকের তপশিলভুক্ত করা হয়।

এর পর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০১২ জারি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ হিসেবে সংসদে পাস হয়। এই অধ্যাদেশেরও সব ধারা দুদকের তপশিলভুক্ত করা হয়।

২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনটি সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে আইনের ২৭টি ধারার মধ্যে শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির ধারাটি দুদকের এখতিয়ারভুক্ত করা হয়। এটি চূড়ান্ত করা হয় ২০১৬ সালের জুনে। এতে দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, জালিয়াতি, প্রতারণা, চোরাচালানি, শুল্ক্কসহ অন্যান্য অপরাধ দুদকের এখতিয়ারে রাখা হয়নি।

আইনমন্ত্রী যা বলছেন :এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যেসব সংস্থার সঙ্গে যে ধরনের অপরাধ সম্পৃক্ত তারা সেসব বিষয়ে তদন্ত করবে। এই চিন্তা থেকে মানি লন্ডারিং আইনের ক্ষমতা সাতটি সংস্থার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। বিদেশেও এভাবে কাজ করা হচ্ছে। একই অপরাধ একই সঙ্গে একাধিক সংস্থা তদন্ত করলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক আইনি প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া টাকা বিদেশ থেকে এখনও ফেরত আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সক্রিয় হতে হবে। দুদক শুধু সরকারি কর্মচারীদের মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করতে পারে- এ কথা সঠিক নয়। তবে তাদের কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে তারা আমাকে জানাতে পারেন।

আইন সংশোধনের পর গত ছয় বছরে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদক ছাড়া অন্য সংস্থাগুলো সাফল্য দেখাতে পারেনি- এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, হতে পারে। আবার এও হতে পারে, তাদের তদন্তকাজ চলমান।

দুদক চেয়ারম্যান যা বলছেন :দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, মানি লন্ডারিং আইনের ব্যাপারে আমাদের কিছু পর্যক্ষেণ রয়েছে। আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। মানি লন্ডারিং আইনটি ফের সংশোধন করে দুদকের কাজের পরিধি বাড়ানোর সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা কাজ করছি। আমাদেরকে আরও সুযোগ দেওয়া হলে কাজের গতি বাড়বে। সরকার আমাদেরকে যতটুকু সুযোগ দেবে আমরা ততটুকু করব।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক যা বলছেন :ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানি লন্ডারিং আইনের সব ধারা দুদকের নেতৃত্বেই থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো দুদককে সহায়তা করবে। আইন সংশোধনের নামে এই আইনের ক্ষমতা অন্য সংস্থাগুলোর ওপর অর্পণ করে দুদককে দুর্বল করা হয়েছে। এ কারণে দুদকের কাজের পরিধি সংকুচিত হয়ে এসেছে। বিভিন্ন দেশের মানি লন্ডারিং আইন স্টাডি করে আইনটি আবার সংশোধন করে দুদকের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো উচিত।

তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে মানি লন্ডারিং আইনটি কেন সংশোধন করা হয়েছিল; এ ক্ষেত্রে কারও স্বার্থ ছিল কিনা- সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।

সূত্রঃ দৈনিক সমকাল।